If you have a problem, fix it. But train yourself not to worry, worry fixes nothing. - Ernest Hemingway

Saturday 24 August 2019

কলকাতা ৪৬



বেশ একটু গর্বের সঙ্গে আপনাদের জানাতে পারি যে এই পুঁথিটির লেখিকা স্বয়ং বেশ কয়েকবার আমাদের হাজরা মোড়ের বাড়িতে এসেছেন।
সে সময় তাঁর বয়েস আট কি নয়। আমাদের বাড়িতে তাঁর চেয়ে দু-চার বছরের ছোট দুটি শিশু ছিল; তাদের নিয়ে তাঁর আহ্লাদের অন্ত ছিলনা। জীবন্ত পুতুল দুটি নিয়ে উর্বীর খেলা আর শেষ হতনা, যদিও শেষ বাসের সময় এগিয়ে এলে ওর মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন, স্বাভাবিক ভাবেই। ওদের বাড়িটাও ছিল একটু খটমট যায়গায়, পার্ক সার্কাসে রেললাইনের ওপারে, সব ঋতুতে দুঃখী মানুষে ভরা চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের হতাশার বৃত্ত ছাড়িয়ে। (একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই, হাসপাতালের নাম “চিত্তরঞ্জন” কোন বুদ্ধিতে দেয় মানুষ?)
এই সময়, অনেকগুলো ডেডলাইন পার হবার পর, যখন মাকে আরে কিছুতেই দাবীয়ে রাখা যাচ্ছেনা, উর্বী তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতেন, “আমি দুধ খাবো।”
এমন বাঙালি মা-মাসি অদ্যাপি জন্মান নি যাঁরা শেষ বাস ধরতে হবে এই তুচ্ছ কারণে দুগ্ধ পিয়াসী শিশুকন্যাকে বঞ্চিত করবেন। সুতরাং ঝটপট দুধ বেরত, ঈষদুষ্ণ গরম করা হত, এবং সেই এক গ্লাস দুধ উর্বী খেতেন বড় খেয়াল গাওয়ার স্টাইলে, বে-শ খানিকটা সময় নিয়ে।
ঘটনাচক্রে ওদের বাসস্থানের খবর আপনাদের দিয়ে দিয়েছি ওস্তাদ লেখকের মতো, কারণ পার্ক সার্কাস রেল লাইনের পিছনে, মূলত গরীব মুসলমান অধ্যুসিত যায়গা, যে এলাকার claim to fame হচ্ছে একটি মানসিক হাসপাতাল, তিনটি মুসলমান ও একটি হিন্দু কবরখানা, এবং রেললাইনের ওপারে সংশয়-উদ্রেককারী নামের আড্ডিবাগান বস্তি – এই নিয়ে, এবং আরও অনেক কিছু নিয়েই উর্বীর বই, এক নিঃশ্বাসে পড়তে হবে এরকম ২০৭টি অনন্যসুন্দর পৃষ্ঠা।
মূল শহরের সীমারেখার ঠিক বাইরে, ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, মেট্রপলিটান ডেভলাপমেন্ট অথারিটি ইত্যাদির সদাশয় দৃষ্টি এড়িয়ে, প্রায় আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই এলাকাটিতে আগাছার মতই ভেসে আসা নানা অনাবশ্যক flotsam and jetsam-এর মত মানুষজন, যাঁদের মধ্যে আছেন নেপালি খ্রিস্টান সিকিউরিটি ইন-চারজ ও তাঁর হিন্দু বাঙালি বউ, জনৈক হিন্দু মালায়ালি স্বামী আর তার ভিন রাজ্যের খ্রিস্টান বৌ, যাকে সে পরিচয় দেয় সেক্রেটারি হিসেবে, একজন গরীব পাদ্রি, বিগত দিনের দিকপাল ফুটবল খেলোয়াড় রশিদ, যে এখন বৃদ্ধ ও নির্ভেজাল মাতাল, রক্ষণশীল ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে, যে অনেক লড়াই করে আর্টিস্ট হয়েই ছাড়ল, অথবা পিতৃহীন দুটি মেয়ে সাফল্য খুঁজে পেতে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে গেল, এরকম আরও অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্র এবং অবশ্যই কয়েক হাজার দরিদ্র মুসলমান পরিবার। এদের নিয়েই পোস্ট কোড কলকাতা ৪৬। এদের নিয়েই উরবীর ভারতবর্ষের ছবি। এবং কত যে অসাধারণ গল্প লুকিয়ে ছিল এদের সাধারণ জীবনযাপনে। (আধুনিক বাংলায় নাকি শুধু "যাপনে" লিখলেই চলত?)
উর্বীর বাবা-জ্যাঠারা নেহাতই লিবরাল হিউমানিস্ট ছিলেন, তাই এই পরিবেশে সেই শিশু বয়েস থেকেই মেয়েটির মেলামেশা ছিল সব রকমের মানুষজনের সঙ্গে, গরীব, দুঃখী, বিচিত্র ভারতবর্ষের একটা microcosm-এর সঙ্গে। শিশু এবং কিশরীর চোখ দিয়ে দেখা এই ছবিটা আমি কোন দিন ভুলতে পারব মনে হয়না।
অতঃপর কিশরীটি বড় হয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি করে এসে সে এখন অধ্যাপক। পরিচিত পৃথিবীকে খুঁজে না পাবার বেদনা নিয়ে স্মৃতিচারণ শেষ হয়। শেষ হয় আমাদের সমষ্টি থেকে ব্যক্তিতে যাত্রায়, কেমন করে অনিদ্রা থেকে দুঃস্বপ্নে আমাদের যাত্রায় কাক ডাকে, তাই দিয়ে।
শেষে একটা কথা বলি। মনে হয় কলকাতা ৪৬ নামটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন লেখিকা, ইতিহাস চর্চা দিয়ে যাঁর রুজিরুটি। ৪৬-এর দাঙ্গা ও বিভাজন না হলে কলকাতা পুরোপুরি অন্যরকম একটা শহর হত, আর কলকাতা ৪৬-ও লেখা হতনা।
আজ আমরা একই রকমের একটা বিভাজনের সামনে দাঁড়িয়ে। উর্বীর বইটি সেই কারণেও আপনার পড়া প্রয়োজন।
*
পুনশ্চঃ গোবরার কবরখানা ইত্যাদি ৮০/৯০ বছর আগেও ছিল, এবং সেখানে কোন ইংরাজি-নবীশ টেনিস ও শিকারপ্রিয় anglophile হিন্দু বাঙালির বিশাল বাড়ি হাঁকানোর কথা নয়। এমনকি, সম্পন্ন মুসলমান বাঙ্গালিরও নয়। লেখিকার পিতামহ কেন এই কর্মটি করেছিলেন তা ভাঙবো না। কারণ তা হলে লেখিকার পরিবারের ব্যতিক্রমী মানুষদের প্রথাভাঙ্গা জীবনের অনেক গল্প বলতে হয়। অতটা টাইপ করার আগে আমার ডাক এসে যাবে!


২৩/০৮/২০১৯

No comments:

Post a Comment

I will be happy to read your views, approving or otherwise. Please feel free to speak your mind. Let me add that it might take a day or two for your comments to get published.